টুকরো টুকরো লেখা ২২

টুকরো টুকরো লেখা ২২

শুক্রবার পর্যন্ত ভূতের মতো কাজ করেছি। টানা চারদিন ইস্টারের বন্ধ। গত সপ্তাহজুড়ে যেই বিশাল কর্মতালিকা বানিয়েছিলাম তাতে ধূপধুনো দিয়ে ঘুমের উপর আছি। পরিকল্পনা একটা ভ্রান্ত ধারণা। এই মহাসত্য জানা সত্ত্বেও একের পর এক ভ্রান্তির টানেলে ক্রলিং করছি। এর শেষ খুঁজতে যাওয়াও একটা ভ্রান্ত ধারণা।

১.

বঙ্গবীর ডিগবাজী মারছেন বেশ অনেক বছর আগেই। এখন আস্তে আস্তে পলিটিক্যাল ক্লাউনে পরিণত হইতেছেন। চারিদিকে পরিবর্তনের জোয়ার। সবাই চেঞ্জ হইতে চায় চেঞ্জ দেখতে চায়। দিনকাল অন্যরকম। এতোকাল পত্রিকা মারফত জানতাম তিনি মূলত ঢুশঢাশ লাইনের লোক। সেদিন বিডি নিউজে দেখলাম এখন তিনি বেশ পরহেজগার হইছেন। দেইখা কলিজাটা ঠাণ্ডা হইয়া গেলগা। ভালো থাকেন বঙ্গবীর। আমরা ধইরা নিলাম নিচের ছবিটা আপনার না।

ছবিটা যার মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে বঙ্গবীর বইলা আমরা তারেই চিনুম। আপনে থাকেন আপনার গামছা লইয়া।
২.

পটুয়াখালীর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ডাইনিঙে শুনলাম গরুর গোস্ত নিষিদ্ধ করা হইছে। আমি উপমহাদেশের সব থিকা বড় ছাত্রাবাসগুলির একটাতে সাড়ে চাইর বছর থাকছি। মিলপ্রতি আট টাকা কইরা দিতাম সেই সময়। তখনো গোমাংস বাংলাদেশে এমন কিছু সস্তা ছিলো না। আর আমাদের হলে কমপক্ষে পঞ্চাশজন সনাতন ধর্মাবলম্বী বাস করতেন। কোনদিন শুনি নাই যে তাঁদের জন্য গরুর বিকল্প কিছু রান্না করা হয় নাই। সুতরাং নির্মলবাবু দ্রব্যমূল্যের এবং সনাতন ধর্মাবলম্বী ছাত্রদের যে দোহাই দিলেন সেইটা ধোপে না টিকার মতোই। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সুবুদ্ধি হউক। মেনুতে গোমাংস ফিরুক এই প্রত্যাশাই করি।
তবে দেশে গরুর মাংসের দাম যে গত এক দশকে অস্বাভাবিক রকম বাড়ছে এইটা ঘটনা। আমি যখন প্রথম বাজারে যাই সেই আশির দশকের শেষের দিকেও গরুর মাংসের কেজি ছিল পয়ত্রিশ থিকা চল্লিশ টাকা। সেইটা বাড়তে বাড়তে চুরানব্বই-পচানব্বই নাগাদ ষাইট টাকায় আসে। দুই হাজার সালের শুরু পর্যন্ত সেইটা সিজন অনুসারে ষাইট থিকা সত্তুর-পচাত্তুরের মধ্যে ওঠানামা করতো। এর পরে মিলেনিয়ামে আইসা সেইটা হাইজাম্প দিলো। কারণ হিসাবে পত্রিকা মারফত জানলাম ভারতীয় গরুর “অনুপ্রবেশ” রোধ করতে গিয়াই এই দশা। নব্বই দশকের প্রথমার্ধেও দেখতাম অনেক রিক্সাচালক-বেবি ট্যাক্সি চালক হোটেলে পরোটা-গরু দিয়া প্রাতরাশ সারে। মোড়ের হোটেলগুলিতে এক বাটি গরুর গোস্ত ছয় থিকা আট টাকা আর বাড়ি মারা খাস্তা পরোটা একটাকা। মোটামুটি বারো থিকা চৌদ্দটাকার মধ্যে তখন চা-বিড়ি সহ গ্র্যান্ড প্রাতরাশ সম্ভব ছিল। যেই অমানুষিক শারিরিক পরিশ্রম তাঁরা করেন তার জন্য সকাল বেলা ভারী নাস্তা খুব জরুরি। এখন যে দ্রব্যমূল্যের কথা শুনি তাতে তো ভাজি দিয়া বাজে পরোটা খাইতে গেলেও বিশটাকা বাইর হইয়া যাওয়ার কথা। চা-বিড়ি না হয় বাদই দিলাম। আমার প্রশ্ন হইলো আমাগো দেশে কি কোনভাবেই গরুর উৎপাদন বাড়ানো যায় না? দেশে এতো পয়সাওয়ালা লোকজন আছেন তারা কি এই খাতে কিছুটাকাও খাটাইতে পারেন না?
যা বুঝতাছি এর একটাই সমাধান আছে। সেইটা হইলো আমারে একটা জ্যাকপট পাইতে হইবো। তারপর অচ্ছুৎ বলাইয়ের বন্ধুরে সেইখান থিকা এককোটি টাকা দিমু। সে একটা বড় সাইজের জমিতে একটা ফার্ম বানাইবো। সেইখানে সারা দুনিয়া থিকা উত্তেজিত ষাড় আর লাস্যময়ী গাভী কিনা আইনা রাখা হবে। বাইরে থিকা তাগো খালি দরকার মতো খাওন দেওয়া হবে। ব্যস। ঐখানে তাগো একটাই কাম। পাঁচ বছরে তাগো সংখ্যা অন্তত পাঁচগুণ হইবো। তারপর পুলাপান লায়েক হইলে তারাও কর্তব্য বুইঝা যাইবো। এইভাবেই একদিন বর্তমান ওয়েজ লেভেল স্থির রাইখা গরুর গোস্ত কেজিপ্রতি পঞ্চাশ টাকায় নামবে। মাছেভাতে বাঙালী গরুভাতে শিফট করবে। বাংলাদেশ হবে এশিয়ার আর্জেন্টিনা। বাঁচুকমরুক যাই করুক গরু খাইয়াই করবো।
অপেক্ষা শুধু জ্যাকপটের …..

৩.

বরাহ শিবিরে স্মৃতিভ্রম শুরু হইছে। বাড়িতে সবাই তাওয়া কড়াই রেডি রাখেন। স্মৃতি ফিরাইতে থ্রীস্টুজেস মডেলের বিকল্প নাই।

উটপাখী’র ডায়রী

সিরিজ খেলাপী, ই-বুক খেলাপী ইত্যাদি সুনাম আমার আছে। রিসেশানের যূগে খেলাপী হওয়াটা বিচিত্র কিছু না। ক্রেডিট ইন্সটিটিউটকে দেনাদার যা বলে এক্ষেত্রে সচলে আমার পাঠকদেরও সেরকম প্রতিশ্রুতি ছাড়া আর কিছু দিতে পারছিনা। খালি এটুকুই বলতে পারি…সবটাই ক্রমে আসিতেছে…সাথে এই আরো একটা যোগ হলো। এই আর কি….
১.

একখাবলা সিগারেটের খোল মনিটর আর উফারের মাঝখানে ঢাকনা ভাঙা ক্যালকুলেটর আড়াল করে নির্লিপ্ত পড়ে আছে। ডানপাশে শরিরের আধখানা ঝুরঝুরে মানিব্যাগ আর বাকিটা মাল্টিপ্লাগে ঢেলে দিয়ে জিজ্ঞাসু শুয়ে আছে আধপাতা প্যারাসিটামল। টেবিলের বাকিটা জুড়ে ধোঁয়াচ্ছন্ন সিপিইউ, বর্তমান মোবাইল, দুইবছর আগের বাতিল মোবাইল, গোটা চার খালি তামাকের ঠোঙা, একটা আধাভরা তামাকের ঠোঙা, লাইটার, দেশলাই, বীয়ারের লাইনার, উপচে পড়া ছাইদান, ওয়াইন ওপেনার, হাবারমাসের থিউরি অফ কমিউনিকেটিভ অ্যাকশানের পেপারব্যাক প্রথম খণ্ড, বাদামের খোল, শুকনো দারুচিনি, মাস ছয় আগের টেলিফোন বিল, অনিয়মিত ছড়িয়ে থাকা বাতিল ট্রিপল-এ ব্যাটারি, একজোড়া সস্তা এয়ারফোন আর গোটাদুই নকিয়া-চিকন আর একটা নকিয়া-মোটা চার্জার সুপ্রচুর তামাকের গুড়া আর বিশুদ্ধ ধূলা মেখে মীমাংসার অযোগ্য দ্বন্দ্বে জড়িয়েছে। টেবিল ল্যাম্পের স্ট্যান্ড থেকে সিপিইউ-মনিটর-সাউন্ডবক্স আর উফারকে একই নেটওয়ার্কে আনতে মাকড়সাগুলি কয়েকমাস ধরে খুব খাটছে। এই শ্রমকে পূর্ণ শ্রদ্ধা জানিয়ে কখনো ছয়টি কখনো আটটি কখনো একসাথে দশটি আঙ্গুলের ডগা কী-বোর্ড থেকে নিয়মিত ধূলা মেখে চলেছে। আঙ্গুলের সরণ সাপেক্ষে মনিটরের স্ক্রীনে পরবর্তী পরিবর্তনগুলি কোনরকমে প্রতিফলন পাচ্ছে।
কোঁৎ করে চ্যাপ্টা বোতলের চারের এক সস্তা ভদকাটুকু মেরে দিয়ে আঙ্গুল গুলি আবার সেই কী-বোর্ডের ধূলিসাগরে ঝাঁপ দেয়। টাইপিঙের খুটখুট শব্দের সাথে পাল্লা দিচ্ছে উইন্যাম্পে চলমান সোয়া পাঁচঘন্টার ম্যারাথন প্লেলিস্ট। তার এই প্রান্তে রক অ্যারাউন্ড দ্য ক্লক ঐ প্রান্তে রক অ্যান্ড রোল ট্রেইন। খুব বেছে বেছে তৈরী করা ৫৭ বছরের একটা অ্যান্থোলজি।
কিছু একটা জন্ম নিচ্ছে। ৫৭ বছর সঙ্গমের অনুশীলন বা অভিনয় দাবী করে এমন একটা কিছু। কবিতা হতে পারে, গান হতে পারে, প্রবন্ধ হতে পারে, গল্প হতে পারে, উপন্যাস হতে পারে, নাটক হতে পারে, স্ক্রিপ্ট হতে পারে, বালছাল হতে পারে, ধুনফুন হতে পারে, এমনকি মেগাবাইট খানেক ওয়ার্ড ফাইলও হতে পারে। সময়টা খরচ হচ্ছে নির্দিষ্ট কোন সঞ্চালনে এটাই ঘটনা।
অ্যান্থোলজি সত্তর দশকের মাঝামাঝি। ডীপ পার্পল ভেঙে রেইনবো হবো হবো সময়। প্রথমে ডান হাতটা দুই খাঁচার মাঝখানটা চেপে ধরলো। তারপর দুই হতে বাম দিকে। ঠেলা দিতে চেয়ার উল্টে ধূলিমাখা মেঝেতে উপুর হলেন আঙ্গুলগুলির মালিক। উইন্যাম্পে লঙ লিভ রক অ্যান্ড রোল।
২.

– আমাগো ইমিডিয়েট আগের জেনারেশান পর্যন্ত মাইনসের পুরা সেরকম ঝোল আছিল বুঝছস! খাওন জুটে কৈ থিকা হিসাব নাই আটকালচার দিয়া ছ্যাড়াব্যাড়া। আমাগো টাইমটা ডিফরেন্ট। কাম আছে ট্যাকা আছে খরচো করার জাগা আছে, মাগার ঐ বালের আটকালচার করার টাইম নাইক্কা।

– ঠিকই কইছস মনে হয়। মাগার আটকালচার করা পাবলিকগুলা একসময় না একসময় বহুত নাম কামাইছে। কামাইয়া টাইম মতো ঠিকই কালচার-ট্রেড করা ধরছে ……

– কয়জন? পঁচিশ বছর আগের থিকাই ধর। উননিশো পাঁচাশি থিকা আইজকা এই দুই হাজার দশ। কয়টা মাল কামাইন্যা কালচারকাকু পাইছস এর মধ্যে? খুব বেশী হইলে পঞ্চাশ জন?

– এ্যাতো হইবো না …

– পঁচিশ?

– তাও না.. টাইনা টুইনা পনেরষোল হৈতারে …

– তাইলেই দ্যাখ… জাস্ট মোর দ্যান হাফ এ ইয়ার ….

– কিন্তু এর মধ্যে তো এইজগ্রুপের আলাদা হিসাব আছে। মানে তুই যাগো কালচারকাকু কইতাছোস তারা তো বেশীরভাগই ফিফটিজ-সিক্সটিজের আঁতেল। ঐ সময়টাতে মার্কেট এরকম ক্লামজি ছিল না। হ্যারা সেই সময় প্রিমিটিভ অ্যাকুমুলেশান যা করার কইরা নিছে ….

– এগজ্যাক্টলী! এর পরে যারাই বাজারে জাগা নিতে গেছে তাগো প্রায় সবাইরেই ঐ পঞ্চাশ-ষাইট দশকের পীরসাবগো মুরিদান হইতে বাধ্য হইতে হইছে। এই ট্রেন্ডই চলছে এক্কেরে পৌনে পনের বছর আগের আইটি-ব্যুম পন্ত। আমাগো আগের জেনারেশন মানে তো ঐ সময়ের পোলাপানই।

– তাইলে বটম লাইন কী খাড়াইলো?

– সহজ কথা। মাস্-পাঠকের মনোযোগের ভালোরকম আড়ালে থাকা কিছু প্রকাশিত-অপ্রকাশিত কবিতা বাদে মাঝের তিনসাড়েতিন দশকের অ্যাসথেটিক্স সামনে আইতারে নাই। পুরানা ঝোলে ভাত মাখাইতে মাখাইতে আইটি ব্যুমের টাইমে আইসা প্রথমে কাঁচা ভাত আরো কয়দিন পর পুরা চাইল। ইন দ্য মীন টাইম কাকুরা মরতে শুরু করছে। বাজারে ততদিনে নতুন ক্রয়ক্ষমতা পাওয়া নয়া কিছিমের কনজুমার আইসা পড়ছে …….

– এইভাবে দেখতে গেলে মার্কেট কিন্তু এখন আরো একটা ভ্যাকুয়ামের মধ্য দিয়া যাইতাছে। মাঝে মধ্যে দুই একটা ডিজে’র ছাও আর নয়াবামের ভ্যাক ধরা মোল্লা ঘেঁষা পাতি আঁতেল চ্যাওম্যাও কইরা নিজেরাই কনফিউজড হইতাছে ….

মোবাইল বাজে। মানে বেজে উঠে থেমে যায়। এসএমএস।

– কে রে?

– পালবাবু মাল জোগাড় করছে। কোন ঝামেলা হয় নাই। চৌরঙ্গী’র দিক যাইতে কয়।

– হলে আইলেই পারতো বাল। এখন উঠতে মন চাইতাছে না।

– চল ব্যাটা। পূর্ণিমা আছে। মনা ভাইও আইছে …..

– কছ কি! খাড়া মুটুম মাইরা আহি …..

মীর মশাররফ হোসেন হলের লাল ইটে গোধুলি একাকার হতে থাকে। দুই বন্ধু সোয়া তিন মিনিট রিক্সার অপেক্ষায় থেকে চৌরঙ্গীর দিকে হাঁটা দেয় হল অফিস ডানে ফেলে ..

গল্প

রাজ্জাক তালুকদার। বাড়ি বৃহত্তর নোয়াখালী। জার্মানীতে পা ফেলেন ১৯৯১ সালের জুনে। শ্রীলঙ্কা থেকে জলপথে মিশর-তুরস্ক-ইটালি-পোল‌্যাণ্ড পেরিয়ে কোন না কোন ভাবে একসময় জার্মানী। যথারীতি পাসপোর্ট খুইয়ে রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদন। আশ্রয় কেন্দ্রে কিছুদিন কাটিয়ে বিভিন্ন রেস্তোরার রান্নাঘরে। হাতে কিছুমিছু ডয়েশ মার্ক। আমলাতন্ত্রের কল্যাণে পাওয়া সময়ের সুযোগে কাগজের বউ জোটে। নানা ঘটনা নানা অঘটন শেষে কাগজের বউয়ের হাত থেকে খালাস পেয়ে ২০০১ সালের কোন একদিন স্থায়ী বসবাসের অনুমতি মেলে। তারপর এক দশক ধরে কখনো সহ-রাধুনি কখনো সার্ভিস কখনো সামাজিক সাহায‌্যভূক কখনো ব্যর্থ ব্যবসায়ী। ২০০৮ এর মন্দার পরে জার্মান সরকার ঘাড়ে ধরে কোন এক কারখানায় পাঠায় বৈধ শ্রম বিক্রি করতে। ততদিনে বুদ্ধিশুদ্ধি কিছু বেড়েছে। টুকটাক যন্ত্রগণকের ব্যবহার শিখে গেছেন। জুটে গেছে মাথামোটা স্বদেশী বালিকা।

আরিব্বাস! জার্মানীতে থাকে। বাংলাইংরেজি ভুলভাল বললেও গড়গড় করে জার্মান বলে। তার উপর কোন না কোন তালুকদার বাড়ির ছেলে। রীতিমতো আফ্রিদী! আমেনা বেগম ভাবে একেই তো খুঁজছিলাম এতোকাল! কথায় কথায় ফেসবুক-প্রেম জমে ওঠে। রাজ্জাক কিরা কাটে জার্মানীতে নিয়ে উচ্চশিক্ষার সুযোগ করে দেওয়ার। মাথামোটা বালিকা ভর্তি হয় গোয়থেতে জার্মান ভাষা শিখতে। ২০১০ এর শেষে রাজ্জাক সশরিরে হাজির হয় স্বদেশে। অনেক কায়দা করে রাজ্জাকের বয়সটয়স ঢেকে শেষমেষ বিবাহ। পত্রপাঠ জার্মানী। তারপর বেশকয়েকটা রঙ্গিলা মাস। পাসপোর্ট পেতে জরুরি ভাষা পরীক্ষার মাস কয়েক আগে অন্ত;সত্ত্বা। রাজ্জাকের যুক্তি বয়স থাকতে থাকতে বাচ্চাকাচ্চা না নিলে বংশের মুখ অন্ধকার। প্রথম সন্তানের বয়স বছর পেরোতে আমেনা বেগম আবার ভাষা শিক্ষার স্কুলে যেতে চায়। রাজনৈতিক আশ্রয়প্রার্থী উদ্বাস্তু বাংলাদেশি সমাজে ঢিঢি পড়ে যায়। হাউমাউ করে ওঠে নোয়াখালীর তালুদার বাড়িও। ভাষা শিক্ষা স্কুলের ফর্ম তোলার পর দিন জানা যায় আমেনা আবারও মা হতে চলেছে। সে জোর করেই স্কুলে যেতে চায়। শুরু হয় নির্যাতন। আমেনা বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে পুলিশে খবর দেয়। রাজ্জাকের কান্নাএবং কিরাকাটাকাটিতে শেষ পর্যন্ত বিষয়টা মিয়া বিবির ভুলবুঝাবুঝি বলে পুলিশকে বুঝ দেওয়া হয়। পুলিশ সেটা পুরোপুরি না বুঝে রাজ্জাককে পরোক্ষ নজরদারিতে রাখে।

আমেনা অবস্থাপন্ন পরিবারের মেয়ে। বাবামা শুরু থেকে বিয়ের বিরোধিতা করলেও সন্তানের টানে চলে আসেন জার্মানী। মেয়েকে পরামর্শ দেন যেভাবেই হোক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে। গোপনে হাতে বেশ কিছু টাকাও দিয়ে যান। রাজ্জাক একসময় দয়া পরবশ হয়ে বাড়িতে জার্মান শিক্ষার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে জার্মান মাধ্যমের এক বাংলাদেশী ছাত্রীকে নিয়োগ দেন। আমেনার প্রতি কড়া নির্দেশ থাকে গৃহ শিক্ষিকাকে কোন অবস্থাতেই ঘন্টায় ৫-৬ ইউরোর বেশি না দিতে। আমেনা ততদিনে জেনে গেছে স্কুলে গিয়ে ভাষা শিখলে ঘন্টায় কত করে দিতে হতো। সেই বাংলাদেশী ছাত্রীর সাথে গভীর বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। আমেনা পরবর্তী সেমিস্টার শুরুর আগের ভাষাগত যোগ্যতার পরীক্ষার জন্য প্রায় তৈরি হয়ে ওঠে।

আবার ঢিঢি পড়ে জার্মানীর স্বদেশী সমাজ এবং নোয়াখালীর তালুকদার বাড়িতে। তালুকদার বাড়ির বড় মেয়ে বার্মিংহাম থেকে ফোনে সরাসরি বলেন, “তুই মেট্টিক হাশ কইচ্চসনি? ভৌ’রে ভার্সিটি হড়াইলে খাইল না হরশু ডইচ্চা ভ্যাডা লই ভাগি যাইবো!” আবার নির্যাতন শুরু হয়। আমেনা আবারও গর্ভবতী। মোবাইল কেড়ে নেওয়া হয়। বাংলাদেশী ছাত্রী দীর্ঘশ্বাস ফেলে সরে আসতে বাধ্য হয়।

এরপরের গল্পে আর নতুন কিছু নাই। ছিমছাম মাথামোটা সুন্দরী আমেনা এখন দৈর্ঘ্যেপ্রস্থে সমান। বড় ছেলেটা কোন রকম হাঁটে। ছোটটা হামাগুড়ি দেয়। মেয়েটা প্যারাম্বুলেটরে। বিশ্ববিদ্যালয় এখন হারিয়ে যাওয়া অতিরিক্ত চিনি দেওয়া স্বপ্ন।

দুই.

শাহেদ মেধাবী ছাত্র। গণিত-ইংরেজিতে তুখোড়। মাঝেমধ্যে গোপনে এটাসেটা মুখে দিলেও বেসিক্যালি ধর্মভিরু। দেশে বছর খানেক তড়িত প্রকৌশলীর চাকরি করে জার্মানীতে আসে উচ্চশিক্ষা নিতে। সেখানেও কৃতি। পরিবার আর স্বদেশের মুখ উজ্জল করে বাগিয়ে ফেলে জার্মানীতে সক্রিয় কোন বহুজাতিক কোম্পানিতে চাকুরি। পরিবারকে সাফ জানিয়ে দেয় বিয়ে সে স্বাদেশের কোন ধার্মিক এবং শিক্ষিত মেয়েকেই করবে। পশ্চিমের আধা-নেংটা মেয়েদের জন্য তার দিলে সাফ নফরৎ। পরিবারের মুখ উজ্জলতর হয়। কোন এক বড়দিনের ছুটিতে দেশে গিয়ে ছেলে কলমা পড়ে ফেলে। আশফিয়া মোটামুটি পর্দানশীন এবং তড়িত প্রকৌশলী। জার্মানীতে মাস্টার্স করে চাকরি করার স্বপ্ন দেখে।

ভিসা নিয়ে কোন সমস্যা হয় নাই। দেশ ছাড়ার ৪৮ ঘন্টা আগে আবিস্কৃত হয় আশফিয়া অন্ত:সত্তা। কুটুমান্তরে মিষ্টি বিতড়ন শুরু হয়। বন্ধুরা শাহেদের পিঠ চাপড়ে দেয়। এটা টিটোয়েন্টির যূগ ইত্যাদি। রফা হয় পুত্রসন্তান কিণ্ডারগার্টেনে যেতে শুরু করলেই আশফিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবে। ছেলের বয়স সাড়ে তিন হলে শাহেদ ছেলেকে কিণ্ডারগার্টেনে দিতে গড়িমসি করতে থাকে। স্বদেশী প্রকৌশলী সমাজের গরম আলোচ্য ইউরোপীয় সমাজের অপসংস্কৃতি কীভাবে প্রাচ্যের ধর্মভিরু সমাজকে ধ্বংস করে ফেলতে পারে ইত্যাদি। আশফিয়া ধার্মিক হলেও দেশে থাকতে টুকটাক ছাত্র ইউনিয়ন করতো। শাহেদকে আপাতত তর্কে পরাজিত করে ছেলেকে কিণ্ডারগার্টেনে পাঠায়। এবার উচ্চশিক্ষার পথ মোটামুটি পরিস্কার। সারাজীবন প্রথম হওয়া শাহেদ তীব্র মানসিক যন্ত্রণায় ভোগে। আশফিয়াকে বলে, “তুমি মাস্টার্স করলে আমার পিএইচডি করতে হইবো। এই বয়সে আর পড়ালেখা ভাল্লাগে না।” আশফিয়া বোঝে না। সে তর্ক করে। করতেই থাকে। শাহেদের প্রথম হওয়া বিদ্যাবুদ্ধি আশফিয়ার বেদাতি তর্কের সাথে পেরে ওঠে না। বন্ধুরা বিয়ের রাতে মেকুর হত্যা না করাকেই সমস্যার মূল বলে চিহ্নিত করে। শেষমেষ দেশ থেকে শাহেদের বড় বোন বা রাঙা ফুপু বা ছোট খালা অব্যর্থ বুদ্ধি দেয়। আরেকটা বাচ্চা ধরাইয়া দে, বিপ্লব শ্যাষ ….হিহি।

তাই হয়। আশফিয়াও একসময় সব মেনে নেয়। মাথায় হিজাব ওঠে। সন্তানের জন্য জার্মান ভাষায় আম্পারাসেপারা খোঁজে। ইউটিউবে পিয়েরে ফ্যোগেলের বয়ান শোনে। স্বামীসন্তানের জন্য এটাসেটা রাঁধে। উচ্চশিক্ষার স্বপ্ন আদারসুনতেলমসলায় উবে গিয়ে এক্সোস্টারে সূক্ষ অধ:ক্ষেপ ফেলে। পাকা গৃহিনীর মতো একদিন ক্লিনার দিয়ে সেটাও তুলে ফেলে আশফিয়া।

তিন.

তাবাস্সুম মুনিরার উচ্চশিক্ষার ইচ্ছা কোন দিনই ছিল না। কোন রকমে বি.এ. পাশ করেছে। শুধু চেয়েছে যাকে বিয়ে করবে সে যেন বিদ্যাবুদ্ধিতে ড্যাশিং হয়। দেখতে ভালো লেখাপড়ায় ঠন্ ঠন্ মেয়েদের বিয়ের বাজার বরাবরই রমরমা। বি.এ. পরীক্ষার ফলাফলের কয়েকমাসের মধ্যে বিয়ে হয় জার্মানীবাসী যন্ত্রগণক গবেষক পাত্রের সাথে। আর্যদের দেশে গবেষকের গৃহবধু হয়ে তাবাস্সুম আটখানা।

বছর না ঘুরতেই ঘরে ফুটফুটে কন্যাসন্তান। গবেষক স্বামী পোস্ট ডক্টোরাল শেষ করে অস্থায়ী শিক্ষক হয়ে যান। ঘরে যাকে বলে সুখশান্তি রাখার জায়গা নাই পরিস্থিতি। এর মধ্যে একদিন কথায় কথায় স্বদেশী প্রতিবেশি তনিমা ভাবির সাথে কথা কাটাকাটি হয়। তাবাস্সুমের সুখে প্রবল ঈর্ষাকাতর তনিমা ভাবি বোমা ফাটান। “তোর পরানের পরফেসর কেমনে এই দ্যাশের কাগজ করছে আমরা জানিনা মনে করছ? ছাত্র থাকতে উঠতে বইতে ধলা মাগি ছানতো। পরে চাকরি পাইবো নাকি দিশা না পাইয়া ক্লডিয়ারে কোট-মেরেজ করছে। তিন বচ্ছর ছিল ঐ বেডির সাথে। তারপর কাগজ কইরা তালাক দিয়া দ্যাশে গিয়া তোরে নিকা করছে। এই হইলো তগো চরিত্র!” তাবাস্সুম হতেই পারে না ধরণের তর্ক করার চেষ্টা করে চুপ মেরে যায়। তর্কটর্ক সে পারে না। কয়েকদিন একটানা চুপ থেকে একদিন রাতে গবেষক সাহেবের কাছে জানতে চান ক্লডিয়া ঐতিহাসিক চরিত্র নাকি তনিমা ভাবির কল্পনা। গবেষক সাহেব ছাত্র পড়ানো পাকা লোক। তিনি পরিস্থিতিটা বুঝিয়ে বলেন। ঐ সময়টা জার্মানীতে চাকরির বাজারে খুব মন্দা যাচ্ছিল। ভিসা নিয়ে খুব অনিশ্চয়তা ছিল। তখন অনেক দিনের বন্ধু ক্লডিয়া উদ্ধার করে। তবে ঐ পর্যন্তই। যা হয়েছে শুধুই কাগজের জন্য। এখন তিনি সাফসুতরো পত্নিনিষ্ঠ ভদ্রলোক। তাবাস্সুম বিষয়টা ক্রমশ বুঝতে পারে। পরে একদিন তনিমা ভাবিকে মুখের উপর বলে দিয়ে আসে, “যা করছে কাগজের জন্য করছে। তোমার ভাইয়ের মতো সত্যি পিরিততো আর করে নাই !” তনিমা ভাবিও একসময় পরাজয় মেনে নেন। ঠিকই তো। কাগজের জন্য লোকে তো কত কিছুই করে। তার স্বামীও করেছে। তাই বলে সত্যি পিরিত! ভাইয়ের সাথে আর যোগোযোগ রাখে না তনিমা ভাবি।

এদিকে ক্যালেণ্ডার উল্টাতে উল্টাতে মেয়ে বড় হতে থাকে। একসময় হাইস্কুলের শেস প্রান্তে এসে পড়ে। আর কিছুদিন পরেই বিশ্ববিদ্যালয়। মেয়ে পর্দাটর্দা করে না। বাপের ক্যারিয়ারে সমস্যা হবে। মেয়েকে নিয়ে তাবাস্সুমের কোন দুশ্চিন্তা নাই। পরিস্কার বলা আছে সাদা ছেলেদের সাথে মিশতে পারবা কিন্তু পিরিত করার কথা ভাবতেও পারবা না। মনে কোন সময় ঐ ভাবনা আসলে ঘরে এসে গোসল করবা। মেয়েটাও লক্ষী। মায়ের কথা মেনে চলে। অন্তত মায়ের তাই মনে হয়।

কিন্তু পশ্চিমের হাওয়াবাতাস। মায়ের অতি সতর্ক নজরের আড়ালে সে যে অষ্টম শ্রেণী থেকেই স্টেফানকে ভালোবাসে এই কথা একদিন তনিমা ভাবির সত্যবাদী মেয়ে যয়নব মারফত ফাঁস হয়ে যায়। স্টেফান সুদর্শন। লেখা পড়ায় ভালো । মেয়ে ভেবেছিল যেদিন জানজানি হবে মা খুশিই হবে। হলেন না। তাবাস্সুম প্রতি পনের মিনিটে একবার মুর্ছা যেতে থাকেন। গবেষক সাহেব মেয়েকে শাসাতে গিয়েও পারেন না। তিনি এতোদিনে অনেকটাই জার্মান। তাবাস্সুম কি যেন একটা বিষ খায়। হাসপাতালে নিয়ে পেট পরিস্কার করতে হয়। তারপর বাড়ি এসে একদম চুপ। গবেষক সাহেব মেয়েকে বলেন স্টেফানকে বাড়িতে এনে মায়ের সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে। তাবাস্সুম ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হতে থাকে। স্টেফানকে রান্না করে খাওয়ায়। মেয়ে ধরে নেয় মা মেনে নিয়েছে সবকিছু।

আবিট্যুর অর্থাৎ ত্রয়োদশ শ্রেণির ফাইনাল পরীক্ষার কয়েকদিন আগে মেয়ে ভরদুপুরে স্টেফানকে বাড়ি নিয়ে আসে। ঘরের দরজা লক করতে ভুলে যায়। কী আর হবে? মা তো মেনেই নিয়েছে।

সাড়ে তিনটার দিকে তনিমা ভাবি গবেষক সাহেবের অফিসে ফোন করেন। তাবাস্সুমকে রক্তাক্ত অবস্থায় পুলিশ নিয়ে গেছে। মেয়ের বিছানায় স্টেফানের আর মেঝেতে মেয়ের গলাকাটা লাশ এখনো পড়ে আছে। বাড়ি ক্রিমিনাল পুলিশের হেফাজতে।

নটে গাছটি মুড়লো?